সংখ্যালঘুদের পর প্রগতিশীলদের ওপর হামলাঃ প্রশাসন নীরব ও নিরুত্তর

সংখ্যালঘু ও প্রগতিশীল গোষ্ঠীসমূহের লাগাতার হামলার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছে সম্প্রতি। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি প্রেস ব্রিফিং-এ গত পাঁচ মাসে উঠে এসেছে এই হামলার কথা। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সাথে সাথে প্রগতিশীল মুক্তমনা লেখক/ব্লগার ওপরে হামলার যে হার, সেটা আশঙ্কাজনক বলে আখ্যায়িত হয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর রিপোর্টে এবং আন্তর্জাতিক সরকারী ও বেসরকারী গণমাধ্যমে। এই সমালোচনার কোনো যথার্থ জবাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিতে পারেনি আজতক এবং এই ব্যার্থতাকে বর্তমান অন্তঃবর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে এইসকল আক্রমণ-হামলাকে সমর্থন দেয়া হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে উঠে এসেছে বেশ কিছু সেক্যুলার ও প্রগতিশীল ধর্ম-অবিশ্বাসী ব্লগ/ওয়েবসাইট/মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে লেখালেখি করা বা মন্তব্য করা লেখক/মন্তব্যকারী/ব্লগারদের বাসায় হামলার ঘটনা। বিশেষ করে এথিস্টনোট, এথিস্ট ইন বাংলাদেশ, এথিস্ট এরা এসম্ত প্ল্যাটফর্মে যারা লিখালিখি করেছেন তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আক্রান্ত হয়েছেন বলে সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে। ঢাকায়, চট্টগ্রামে, রাজশাহীতে, কুমিল্লায়, সিলেটে বিশেষ করে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে বলে জানা গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লেখক/ব্লগারদের আক্রান্ত পরিবারেরা নাম প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছেন এবং এইসব হামলার বিচারের জন্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের কাছে কোনো সাহায্য পাননি। অত্র এলাকাগুলোর থানায় যোগাযোগ করলে এ-ব্যাপারে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

আক্রান্ত লেখক/ব্লগারদের মধ্যে নিম্নোক্তদের সনাক্ত করে গেছে – রোমানা আক্তার রুমকি, ফাহিন আলম, মোর্শেদ আলম, আব্দুল কাদের সুমেল, শামীম আল মামুন, শিপলু কুমার বর্মণ, মোঃ জাকির হোসাইন, আবু বকর সিদ্দিক, মোঃ সাব্বির হোসাইন, মোঃ আবির হোসাইন, মনিরা পারভীন, মোঃ ফাহাদ হোসাইন, মিজানুর রহমান সহ প্রমুখ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রলায়য়ের প্রতিক্রিয়া এই প্রতিবেদন লিখা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

 

নিজস্ব প্রতিবেদক

পুলিশ কারও প্রতিপক্ষ নয়: আইজিপি

পুলিশ কারও প্রতিপক্ষ নয় বলে মন্তব্য করেছে পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ। তিনি বলেন, পুলিশ জনগণের সেবক। জনগণের নিরাপত্তায় সব সময় তৎপর রয়েছে। তাহলে কেন সব সময় পুলিশকে প্রতিপক্ষ বানানো হয়? পুলিশ কারও প্রতিপক্ষ নয়।

সোমবার সকালে মিরপুর ১৪ নম্বর স্টাফ কলেজ অডিটোরিয়ামে পুলিশ মেমোরিয়াল ডে ২০২১ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, রোববার (২৮ ফেব্রুয়ারি) প্রেস ক্লাবের সামনে এক পুলিশ সদস্যকে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে। তারপরও পুলিশ সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রেখে কাজ করছে। পুলিশকে পেটানোর ঘটনায় কোনও রিফ্লেকশন হয়নি। এ বিষয়টি নিয়ে কেউ কোনও কথা বলেনি। যারা এদেশে বেশি বড় হয়ে এদেশের বুকে ছুরি মারতে চায় তাদের মুখে ছাই দিতে চায় শৃঙ্খলা বাহিনী।’

আইজিপি বেনজির আহমেদ আরও বলেন, ‘কোনও বিরোধী শক্তির ছোট্ট একটি অংশ রয়েছে। তা বোঝা যায়। সরকারের কোনও অর্জন কিংবা উন্নয়নে তাদের কিছু আসে যায় না।’

এদিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় মামলায় ছাত্রদলের ১৩ নেতাকর্মীকে সোমবার ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।

ঝেড়ে ফেলুন নেতিবাচক মনোভাব

আমাদের চারপাশে প্রায়ই বিভিন্ন অত্যাচার, নিপীড়ন, দুর্নীতি এবং সহিংস কর্মকান্ডের খবর পাই। দৈনন্দিন জীবনে এই সহিংস ঘটনাগুলো আমাদের মস্তিষ্কে কতটা প্রভাব ফেলছে অথবা কতটা নেতিবাচক মানসিকতা তৈরি হওয়ার কারণে দিনের পর দিন এমন নৃশংস কর্মকান্ড বেড়ে চলছে, তা কি আমাদের উদ্বেগের বিষয় নয়?

২০১৮-১৯ এর মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ বা দুই কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নানাভাবে মানসিক রোগে আক্রান্ত। এছাড়া ১৩.৬ শতাংশ শিশু রয়েছে যারা যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত, অপ্রত্যাশিত ঘটনার প্রভাবে নানাভাবে মানসিক সমস্যায় ভোগে এবং বিপর্যস্ত থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বা পারিপার্শ্বিক নানা পরিবর্তন আসার পরেও তারা সেই ট্রমা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। এবার আসি মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সামাজিক ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।  জীবনে সফলতা যেহেতু ব্যর্থতার চেয়ে অনেক বেশি দৃশ্যমান তাই সফলতার সুযোগকেই মানুষ অতি মূল্যায়ন করে। বেঁচে থাকার চেয়ে এখন টিকে থাকার দৌড়েই মানুষ ব্যস্ত। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কে কার চেয়ে বেশি এগিয়ে গেল, কার কত বেশি অর্জন-এই প্রতিযোগিতা মানুষকে অনেকটাই হতাশার দিকে ঠেলে দেয়। কারণ জয়ের কদরের চেয়ে পরাজয়ের ক্ষতিকে আমরা বেশি ভয় পাই। তার মানে এই না আমরা সফলতার উদযাপন করব না। অবশ্যই করব, কিন্তু অন্যকে অবমূল্যায়ন করে নয়।

অন্যদিকে, টিকে থাকার দৌড়ে সাময়িকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর মাঝে চলে আসে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ভীতি। ব্যর্থতা তাদের যতটা না গ্রাস করে, তার চেয়ে বেশি সেই প্রতিযোগী মনোভাব তাদের দুর্বল করে তোলে এবং মানসিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। তাই ঝেড়ে ফেলুন নেতিবাচক মনোভাব। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টান, হয়ে উঠুন ইতিবাচক।

নগর কৃষির আদ্যোপান্ত

আমার ছোটবেলা কেটেছে গ্রামে। খুব কাছ থেকে পরিবেশ ও প্রকৃতি দেখার সুযোগ হয়েছে। আমি আমার মাকে দেখেছি এক চমৎকার কৌশলে সন্ধ্যাবেলায় একঝাঁক হাঁস-মুরগি এক এক করে খুপরিতে তুলতে। দেখেছি কীভাবে মায়ের হাতে লাগানো শিমগাছটি দুই পাতা, তিন পাতা করে বাড়তে বাড়তে একসময় বারান্দা ছাপিয়ে ঘরের আঙ্গিনা ছেয়ে ফেলত।

ক্যালেন্ডারের পাতার মতো সুন্দরভাবে শীতের সকালে কুমড়া ফুল ফুটে থাকতে দেখেছি। বাগান ভরে লালশাকের লাল রঙে রক্তিম হয়ে যাওয়া কিংবা গাছে ঝুলে থাকা কোন লাউ বা কুমড়াটি খাওয়ার উপযোগী হয়েছে, তা আমাদের মা বা নানী-দাদীরা এক আশ্চর্য কায়দায় বুঝে ফেলতেন। এসব শিক্ষাই প্রজন্ম শিক্ষা, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়েছে। বর্তমানে শহুরে প্রজন্ম এ শিক্ষা পায় না বললেই চলে। ফলে শহরে বেড়ে ওঠা শিশুদের মধ্যে প্রজন্ম শিক্ষার অভাবটা দিন দিন বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

তারা জানতে পারছে না, কোন গাছে কোন ফুল বা ফল ধরে। যে কলা কিংবা আনারস তারা খাচ্ছে; তার গাছটি দেখতে কেমন, তারা সেটা জানে না। কবির ভাষায় বলতে গেলে— “বহু দিন ধরে’ বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/ দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা/ দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু/ দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশিরবিন্দু।”

 

এখন তাদের অধিকাংশের অবসর কাটে মোবাইলে গেম খেলে কিংবা টিভিতে কার্টুন দেখে। ফলে প্রকৃতির প্রতি তাদের ভালোবাসা বোধ তৈরি হয় না। এজন্য বাসাবাড়ি বা বিদ্যালয়ের টবে সাজিয়ে রাখা গাছের পাতা ছিঁড়তে কিংবা ডাল ভাঙতেও তাদের কষ্ট হয় না।

ইট, কাঠের যান্ত্রিক শহরে তারা পায় না সত্যিকারের সোনার বাংলার আমেজ। তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শহর ও নগরে বাড়ির ছাদে বাগান করা এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। নানা নকশার বাড়ির ছাদের দিকে তাকালেই বিভিন্ন ধরনের বাগান দেখা যায়।

অবশ্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরের ছাদে যেসব বাগান দেখা যায়, তার অধিকাংশই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলে বাড়ির ছাদে যেকোনও গাছ, এমনকি শাকসবজিও ফলানো সম্ভব। আঙুর, বেদানা, ডালিম, আমড়া, পেয়ারাসহ নানা ধরনের মৌসুমি ফল ছাড়াও কলমিশাক, কলা, ডাঁটা, লাউ ইত্যাদি অনায়াসে উৎপাদন করা যায়।

প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে বর্তমানে ঢাকা শহরে সবুজায়িত এলাকা রয়েছে খুবই কম। এর মধ্যে আবার রয়েছে ৪৫টি পার্ক, ২১টি খেলার মাঠ, নয়টি কবরস্থান, চারটি সংরক্ষিত এলাকা, রেলওয়ের সংরক্ষিত এলাকা ও রোড ডিভাইডার। সব মিলিয়ে এখানে সবুজায়িত এলাকার পরিমাণ চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, কৃষি মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদফতর সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৮৯ সালেও ঢাকায় সবুজায়িত এলাকার পরিমাণ ছিল মোট আয়তনের প্রায় ২০ শতাংশ। সময় গড়াতে গড়াতে ২০০২ সালে তা নেমে আসে সাড়ে ১৫ শতাংশে। ২০১০ সালে তা আরও কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৩ শতাংশে। বর্তমানে ঢাকায় সবুজায়িত এলাকার পরিমাণ ২ শতাংশেরও কম।

রাজধানীতে এখন নতুন বাড়ি রয়েছে ২০ শতাংশ আর পুরনো বাড়ি ৮০ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট প্লটগুলোর আকার ২ থেকে ১০ কাঠা পর্যন্ত। প্রতিটি বাড়ির গড় আয়তন প্রায় পাঁচ কাঠা। এর মধ্যে গাছ লাগানোর জন্য উপযুক্ত স্থান পাওয়া যায় পুরনো বাড়ির ক্ষেত্রে ৩০ ও নতুন বাড়ির ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ। ঢাকা শহরের মোট বাড়ির সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। এর মধ্যে পুরনো বাড়ি রয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার, যার মোট আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ১৮ লাখ কাঠা।

এর মধ্যে সবুজায়নের জন্য উপযুক্ত ৫ লাখ ৪০ হাজার কাঠা প্রায়। নতুন বাড়ি প্রায় ৯০ হাজার, যার মোট আয়তন সাড়ে চার লাখ কাঠা প্রায়, যেখানে সবুজায়নের জন্য উপযুক্ত জমি রয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার কাঠা। সব মিলিয়ে ঢাকায় সবুজায়নের জন্য উপযুক্ত মোট জমির আয়তন ৮ লাখ ১০ হাজার কাঠা বা ৫৮ কোটি ৩২ লাখ বর্গফুট। রাজউক অনুমোদিত নকশায় ৫০ শতাংশ জায়গা ছেড়ে বাড়ি বানানোর নিয়ম রয়েছে। আর পুরনো বাড়ির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ জমি ছেড়ে বাড়ি বানানোর বিধান ছিল।

সুতরাং হিসাবমতে, ঢাকা শহরে বিদ্যমান সাড়ে চার লাখ বাড়ির আঙ্গিনা থেকে পাওয়া সবুজায়নযোগ্য জমির পরিমাণ ৫ লাখ ৮৫ হাজার কাঠা। এর সঙ্গে বাড়ির ছাদকে কাজে লাগিয়ে ঢাকায় যে পরিমাণ জায়গায় বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে, তার চেয়েও অনেক বেশি জায়গায় সবুজায়ন করা সম্ভব।

ঢাকায় যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার অন্তত অর্ধেক প্রতিষ্ঠানে সবুজায়নের সুযোগ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ছাদ, বারান্দা, ক্যান্টিন, ক্লাসরুমের কর্নার বা চলাচলের প্যাসেজে গাছ লাগানো সম্ভব। এছাড়া বাড়িঘর, হাসপাতাল, ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও রোড সাইড প্লান্টেশনকেও এ তালিকায় আনা যায়, সে বিষয়ে ভাবনার কোনও অবকাশ নেই। আর এভাবেই ঢাকা হয়ে উঠতে পারে পরিবেশবান্ধব এক সবুজ নগরী।

আজকাল দেখা যায়, শখ করে অনেকেই ছাদে বাগান করেন। বিষয়টিকে এখন অর্থনৈতিক এক সম্ভাবনার খাত হিসেবেই দেখছেন অনেকে। এমন অনেকেই আছেন, যারা বাড়ির ছাদে বাগান করে পরিবারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বাজারে বিক্রি করে থাকেন। তবে ছাদবাগান মানে অনেকেই মনে করেন এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রকৃতপক্ষে এতে অনেক কম শ্রম প্রয়োজন। ছাদবাগান করতে হলে প্রতিদিন সকাল-বিকাল গাছে পানি দিতে হবে।

এছাড়া গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আরো খেয়াল রাখতে হবে, ছাদবাগানের গাছগুলো মাটিতে রোপণ করা সাধারণ গাছের মতো নয়। তাই সার কিংবা ভিটামিন দিতে হবে খুব বুঝেশুনে। এক্ষেত্রে কৃষি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়া কোনো কিছু প্রয়োগ একদম উচিত হবে না।

মাত্র চার-পাঁচ কাঠা জমির ওপর বাড়ির ছাদে পরিকল্পিতভাবে বাগান করলে অনায়াসে চার-পাঁচ সদস্যের পরিবারের চাহিদা মিটিয়েও বছরে কমপক্ষে ৪০-৫০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক উপায়ে গাছ জন্মানোর এ পদ্ধতি এনে দিতে পারে আর্থিক সচ্ছলতাও। একই সঙ্গে আমাদের পরিবেশ হবে আরো একটু সমৃদ্ধ ও সবুজ। যান্ত্রিক নগরী ফিরে পাবে তার হারানো রূপ।

উপজেলা প্রশাসনে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব কাম্য নয়

স্থানীয় সরকারের তাৎপর্য হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কর্মপ্রক্রিয়ায় স্থানীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া। কিন্তু আমাদের উপজেলাগুলোতে উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ের কারণে স্থানীয় সরকারের মূলমন্ত্র চাপা পড়ে গেছে। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের কাজে বাধা তৈরি করছে ইউএনওদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব। তাঁদের আরো অভিযোগ, ইউএনওরা উপজেলা পর্যায়ে শাসকের ভূমিকা পালন এবং জনপ্রতিনিধিহীন সামন্তবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করছেন। ইউএনওরা উপজেলা পরিষদ নয়, উপজেলা প্রশাসন পরিভাষা ব্যবহার করেন। এই অভিযোগের মধ্য দিয়ে উপজেলা পর্যায়ে শাসনব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলার বিষয়টি আবার সামনে এলো। উপজেলা পরিষদ আইনে  উপজেলা পরিষদকে ‘প্রশাসনিক একাংশ’ হিসেবে স্বীকৃত দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে ৫৯ অনুচ্ছেদ সুস্পষ্টভাবে ‘প্রশাসনের একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার’ নির্বাচিত পরিষদকে দেওয়া হয়েছে; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

উপজেলা পরিষদ স্থাপনের শুরু থেকেই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব লেগে আছে। ১৯৮০-এর দশকে এরশাদ সরকারের সময় যখন উপজেলা পরিষদ গঠন করা হয়, তখন আমি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ছিলাম। সেখানে আমি উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম দেখতাম। তখনো ইউএনও-চেয়ারম্যান বিরোধ ছিল। এসব বিরোধ নিষ্পত্তি নিয়ে আমাকে অনেক সালিস করতে হয়েছে। আমার কাছে চেয়ারম্যানরা এসেছেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা এসেছেন। তাঁদের কথা শুনেছি, মীমাংসা করেছি। তখন কোনো কোনো এমপিও আসতেন নানা অভিযোগ ও আবদার নিয়ে। কোনো কোনো এমপি তো তাঁর এলাকার উপজেলা চেয়ারম্যানকে বরখাস্ত করার জন্য প্রভাব খাটানোর কিংবা প্রলোভন দেখানোর চেষ্টাও করতেন। অর্থাৎ তখন থেকেই এমপিরা উপজেলা পরিষদের কাজে হস্তক্ষেপ করতেন, যেটা আজও আছে। ইউএনও, চেয়ারম্যান ও এমপিদের মধ্যে এই ত্রিপক্ষীয় ক্ষমতার দ্বন্দ্বে উপজেলা পরিষদ এখনো প্রকৃত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি।

১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে উপজেলা পরিষদ বাতিল করে দিয়েছিল। পরের বছর ১৯৯২ সালে তারা এমপিদের উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করে একটা প্রস্তাব আনে। তখন আমাকে এ বিষয়ে একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করে দিতে বলা হয়েছিল। তবে আমি আমার প্রতিবেদনে লিখেছিলাম, এটা সম্ভব নয়। প্রথম কথা হলো, তখন উপজেলা পরিষদ ছিল ৪৬২টি। আর এমপি হলেন ৩০০ জন। আবার আইনগত বাধাও ছিল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত এটা হয়নি বলে রক্ষা। মোটকথা, উপজেলা পরিষদের ওপর কর্তৃত্ব আরোপের চেষ্টা সব সময়ই ছিল।

সাম্প্রতিককালে উপজেলা পরিষদের ওপর হস্তক্ষেপ বেড়ে গেছে। বিদ্যমান উপজেলা পরিষদ আইন  ১৯৯৮-এ উপজেলা পরিষদ গঠনের জন্য একজন চেয়ারম্যান এবং দুজন ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরিষদের সদস্য করা হয়েছে উপজেলার আওতাভুক্ত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌরসভার (যদি থাকে) মেয়র এবং সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের। আর উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা করা হয়েছে এবং তিনি পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবেন বলে আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। পরিষদের উপদেষ্টা করা হয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে, যাঁর উপদেশ গ্রহণ এবং সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাঁকে অবহিতকরণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আইনে তিনটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, উপজেলা পরিষদ একমাত্র স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, যার কোনো সচিব নেই। ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আছে, পৌরসভায় সচিব আছে, জেলা পরিষদে সচিব আছে; কিন্তু উপজেলায় নেই। দ্বিতীয়ত, উপদেশ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করে পরিষদের ওপর এমপির কর্তৃত্বের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই সুযোগে সংসদ সদস্যরা চেয়ারম্যানদের পাশ কাটিয়ে ইউএনওকে আদেশ-নিষেধ বা দিকনির্দেশনা দেন। ফলে আইনগতভাবেই উপজেলাকে একটা বিরোধপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। তৃতীয়ত, চেয়ারম্যানরা যখন তাঁদের ক্ষমতার চর্চা করতে চান, তখন ইউএনওরা সেটা মানতে রাজি হন না। কারণ চেয়ারম্যানের কথা মানার বিষয়ে ইউএনওদের কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতাও নেই। আবার স্থানীয় এমপির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখেন এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এমন উপজেলা চেয়ারম্যানরাও ইউএনওদের হেনস্তা করেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। এর ফলে ইউএনওরা হয়তো নিজেদের গুরুত্ব হারানোর আশঙ্কায় থাকেন। ফলে উপজেলা পরিষদের সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে।

প্রথম যখন উপজেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়, পরিষদের সমস্যাগুলো দেখার জন্য নিকারকে (ন্যাশনাল ইমপ্লিমেনটেশন কমিটি ফর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিফর্ম) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। উপজেলা পর্যায়ে সরকারের যেসব বিভাগ রয়েছে, সেসব বিভাগের সচিবরা মাসে একবার নিকারে আসতেন। সেখানে নানা সমস্যা দেখা হতো। নতুন আইনে সম্ভবত নিকারকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। নিকারকেও এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। পরে ওয়ান-ইলেভেনে আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটা ভালো উদ্যোগ ছিল। তারা স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে একটা লোকাল গভর্নমেন্ট কমিশন করেছিল। কমিশন উপজেলা পরিষদের সমস্যা দেখবে, পরামর্শ দেবে এবং সালিস মীমাংসা ইত্যাদি করবে বলে উল্লেখ ছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে লোকাল গভর্নমেন্ট কমিশন বাতিল করে দেয়। ফলে উপজেলা দেখার মতো কেউ নেই।

স্থানীয় সরকার ধারণাটি হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের একটা মিথস্ক্রিয়া, যাতে স্থানীয় আকাঙ্ক্ষা ও কল্যাণ অগ্রাধিকার পায়। জনগণের পক্ষে কাজটি করে নির্বাচিত পরিষদ। স্থানীয় সরকারকে যতটা না আইনগত, তার চেয়ে বেশি সহজাত প্রতিষ্ঠান বলা হয়;  যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়ে বেশি সামাজিক প্রতিষ্ঠান বলা হয়। কিন্তু আমাদের উপজেলা পরিষদ এই চেতনা থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় সরকার সম্পর্কে আমাদের সংবিধানে যেটা বলা আছে,  সেটাও কার্যকর নেই। আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার কোনো ক্ষমতা হাতছাড়া করতে চায় না। বাস্তবে উপজেলা পরিষদ কেন্দ্রীয় সরকারের আজ্ঞাবহ বিভাগে পরিণত হয়েছে। উপজেলাগুলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের হুকুমে চলে। না হয় এমপির হুকুমে চলে। না হয় ইউএনও সাহেব বাধা দেন। এসব কারণে দৃশ্যমান স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপজেলাকে দেখা যায় না।

উপজেলা পরিষদে আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, উপজেলা পর্যায়ে থাকা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব নিয়ে। উপজেলা পর্যায়ে সরকারের ১৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা আইনে উপজেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু আজও ১৭টি অফিস এক ছাতার নিচে আসেনি। উপজেলা চেয়ারম্যানের মন্ত্রণালয় হলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং ইউএনওর মন্ত্রণালয় হলো ক্যাবিনেট ডিভিশন। ১৭টা ট্রান্সফার্ড প্রতিষ্ঠানও যার যার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে। ফলে উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক কাজে কো-অর্ডিনেশন একটি মারাত্মক সমস্যা।

এই পরিস্থিতিতে উপজেলা পরিষদকে একটা কার্যকর স্থানীয় সরকার হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। উপজেলা পরিষদকে কার্যকর ও উন্নত করা এবং এর কার্যক্রম মনিটরিং করার লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করা দরকার। উপজেলা পরিষদ নিয়ে একটা ইনডেপথ গবেষণাও করা যেতে পারে। ১৭টি ট্রান্সফার্ড প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত পরিষদের সঙ্গে কিভাবে কাজ করবে তা সুস্পষ্ট করতে হবে। সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। চেয়ারম্যানরা যাতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি ইউএনওদের হেনস্তা করতে না পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে ইউএনও সেতুবন্ধের কাজ করবেন—সে ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আরেকটা বিষয় হলো, স্থানীয় সরকার পরিষদগুলোকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবমুক্ত রাখতে দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচনের কারণে স্থানীয় সরকার অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। উপজেলা পরিষদের জন্য একজন সচিব দরকার, সেটাও করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারকেও সব কিছু আঁকড়ে ধরার মানসিকতা ছাড়তে হবে। সর্বোপরি উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করতে হলে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কোনো বিকল্প নেই।

ট্রাম্প আরও কী করবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল সত্যায়নের জন্য কংগ্রেসের উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনের সময় কংগ্রেস ভবনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের হামলা, ভাঙচুর ও নৈরাজ্য সৃষ্টির ঘটনা কেবল অভূতপূর্বই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় বলেই চিহ্নিত হবে। এই হামলার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ঐতিহ্য কালিমাময় হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নির্বাচনের আগে থেকে যে ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়েছে। ট্রাম্প–সমর্থকদের এই আচরণকে সন্ত্রাসী তৎপরতা ছাড়া আর কিছুই বলার নেই। কেননা, রাজনৈতিক আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ক্ষমতা দখলে রাখার জন্য পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালানো হয়েছিল। সন্ত্রাসবাদের লক্ষণগুলোর প্রায় সবই এই হামলার মধ্যে উপস্থিত ছিল। ৩ নভেম্বর মার্কিন নাগরিকেরা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যে রায় দিয়েছেন, তা পাল্টে দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চান ট্রাম্প। তাঁর সমর্থকেরা সেই ইচ্ছা পূরণের জন্যই এই হামলা চালিয়েছেন, সাংবিধানিকভাবে জনপ্রতিনিধিদের ওপরে অর্পিত দায়িত্ব পালনে বাধা দিয়েছেন, তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছেন। সেই কারণেই গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল লোকজন একে বিদ্রোহ এবং অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা বলে বর্ণনা করছেন। এই বর্ণনা যথোপযুক্ত।

বুধবার সমাবেশ ডেকে ট্রাম্প তাঁর সমর্থকদের উসকানি দিয়েছেন। যখন তাঁর সমর্থকেরা কংগ্রেস ভবনে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছেন, সেই সময়ে তিনি নীরব থেকেছেন। যখন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁকে আহ্বান জানান এখনই তাঁর সমর্থকদের শান্ত করতে এবং এমনকি রিপাবলিকান পার্টির ভেতর থেকে নিন্দার ঝড় ওঠে, তখন তিনি একটি ভিডিও বার্তা দেন। কিন্তু তাতেও তিনি হামলাকারীদের নিন্দা না করে তাঁদের দেশপ্রেমিক বলে বর্ণনা করেন এবং তাঁদের প্রতি ‘ভালোবাসার’ কথা বলেন। পরে টুইট করে একই ধরনের সমর্থনই ব্যক্ত করেছেন। এই ঘটনাপ্রবাহ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ওপর একটি বড় আঘাত। যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র গৃহযুদ্ধের পর এতটা প্রত্যক্ষভাবে হামলার শিকার হয়নি। আর সেই হামলা যে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট নিজেই তৈরি করেছেন, সেটাই আরও বেশি উদ্বেগের।

হামলা ও সন্ত্রাসের এই ঘটনা আপাতদৃষ্টে অভাবনীয় মনে হলেও এটি একার্থে মোটেই বিস্ময়কর নয়। চার বছরের বেশি সময় ধরে ট্রাম্প যেভাবে এক উগ্র সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করেছেন, রিপাবলিকান পার্টিকে তাঁর করায়ত্ত করেছেন, স্বৈরাচারী আচরণ করেছেন, সংবিধানকে অবজ্ঞা করেছেন এবং দেশকে বিভক্ত করেছেন, তাতে এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হওয়া কোনো অস্বাভাবিক বিষয় ছিল না। গত গ্রীষ্মকাল থেকে তিনি নির্বাচনের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যেসব আয়োজন করেছেন এবং নির্বাচনের পর থেকে জালিয়াতি হয়েছে বলে মিথ্যাচার করেছেন, এই পরিস্থিতি তারই পরিণতি। তাঁর কট্টর সমর্থকদের তিনি তাতিয়ে তুলেছেন নির্বাচনী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যেকোনো স্বৈরাচার নেতা যেভাবে তা করেন, ট্রাম্প তা থেকে ভিন্ন আচরণ করেননি। তাঁর সমর্থকদের এখন কার্যত লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে গণতন্ত্রকেই ধ্বংস করতে।

কিন্তু এই পরিস্থিতির দায় একা ট্রাম্পের নয়। রিপাবলিকান পার্টির যেসব নেতা গত চার বছর তাঁকে এই আচরণ করতে সাহায্য করেছেন, তাঁকে দায়মুক্তি দিয়েছেন, এই অবস্থার দায় তাঁদেরও। বুধবার যা হওয়ার কথা ছিল, সত্যায়নের আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। রিপাবলিকান পার্টির যেসব কংগ্রেস সদস্য ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অভিলাষের কারণে একে ট্রাম্পের ক্ষমতা রক্ষার উপায়ে পরিণত করেছেন, এর দায় তাঁদের। যাঁরা এই মিথ্যাচার অব্যাহতভাবে প্রচার করেছেন যে নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে, এমনকি আদালতে ৬০টি মামলা খারিজের পরও তা থেকে বিরত হননি, এই পরিস্থিতি তৈরির দায় থেকে তাঁরা মুক্ত থাকতে পারেন না। এই হামলার পর যেসব কংগ্রেস সদস্য ট্রাম্পের হয়ে কংগ্রেসে ফল সত্যায়নে আপত্তি জানিয়ে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের এই আচরণও এখন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলেই বিবেচিত হওয়া দরকার।

ভবিষ্যতে ট্রাম্প কী করবেন এবং নিরাপত্তার প্রশ্ন কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সেই নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ আছে। সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখন সময় উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার।

প্রশ্ন হচ্ছে, এরপর কী হবে? এই সন্ত্রাসী ঘটনাই কি শেষ ঘটনা? দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এখানেই তার শেষ হবে, এমন মনে করার কারণ নেই। ট্রাম্পের সমর্থক এবং রিপাবলিকান পার্টির একাংশ এই ধরনের তৎপরতা অব্যাহত রাখবে, যদিও দলের একাংশের মধ্যে এখন সামান্য হলেও বোধোদয় হয়েছে। আশা করা যায় যে যাঁরা এত দিন ট্রাম্পকে ‘শান্তিবাদী’ বলে মনে করতেন—দেশে এবং দেশের বাইরে—তাঁরা বুঝতে পারছেন যে তিনি এবং তাঁর সমর্থকেরা শান্তি নয়, আইনের শাসন নয়, চান যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। এই উদ্বেগের মধ্যেও সান্ত্বনার বিষয় হচ্ছে, ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক প্রত্যাখ্যান করেছেন ২০১৬ সালে এবং ২০২০ সালে আরও বড় আকারে। ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের একাংশকে প্রতিনিধিত্ব করেন, কিন্তু ট্রাম্পকেই যুক্তরাষ্ট্র মনে করার কারণ নেই। নাগরিকদের মধ্যে তাঁর আবেদনের যে সীমা আছে, সেটা বিবেচনায় না রাখলে মার্কিন রাজনীতির ভবিষ্যৎ বোঝা যাবে না।

এই হামলার পর কংগ্রেসের যুক্ত অধিবেশন আবার বসেছে সাংবিধানিকভাবে, যে দায়িত্ব কংগ্রেসের ওপর দেওয়া আছে, সদস্যরা তা পালন করেছেন—এটা যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর, শাসনকাঠামোর শক্তির প্রমাণ দিচ্ছে। ৩ নভেম্বরের পর রাজ্য সরকারগুলোর কাঠামোগত শক্তি, আদালতের স্বাধীনতার অসংখ্য উদাহরণ তৈরি হয়েছে। কংগ্রেসের অধিবেশন অব্যাহত রাখা এবং জো বাইডেনের বিজয়ের সত্যায়নের প্রক্রিয়ায় জনগণের ভোটের প্রতিফলন ঘটেছে। এই বিষয়েও সন্দেহের কারণ নেই, ২০ জানুয়ারি জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন। ট্রাম্প চান অথবা না চান, তাঁর সমর্থকেরা আরও সন্ত্রাসী তৎপরতা চালালেও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা প্রকাশিত হয়েছে, তার ভঙ্গুরতা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। বুধবারের ঘটনাপ্রবাহ আবার তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদেরা সেই বিষয়ে কী করবেন, সেটাই এখন প্রশ্ন।

এই প্রশ্নও উঠেছে যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগামী দুই সপ্তাহ কী ধরনের আচরণ করবেন, গণতন্ত্রের ওপরে সহিংস হামলার যে পথ তিনি উন্মুক্ত করেছেন, তাকে কোথায় নিয়ে যাবেন। কেননা, ক্ষমতায় থাকার সব ধরনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি এখন বেপরোয়া। নির্বাহী ক্ষমতার ব্যবহার ঘটিয়ে তিনি আবার এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করবেন না বা রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে অভ্যুত্থানের চেষ্টা তিনি করবেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়। তাঁর এবং তাঁর সমর্থকদের আচরণ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যই হুমকি হয়ে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে কংগ্রেস ভবনের নিরাপত্তা বিধানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গ্রীষ্মকালে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার বলে গড়ে ওঠা নাগরিক আন্দোলন মোকাবিলা নির্বিচার শক্তি প্রয়োগে দ্বিধা দেখা যায়নি, কিন্তু একটি সমাবেশের কথা জানার পরও কোনো রাজধানীতে নিরাপত্তা জোরদার ছিল না, সেটা অবশ্যই প্রশ্নের উদ্রেক করে।

ভবিষ্যতে ট্রাম্প কী করবেন এবং নিরাপত্তার প্রশ্ন কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সেই নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ আছে। সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখন সময় উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট

দুই ডলারের টিকা পাঁচ ডলারে কেন?

অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা (যা করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশে আমদানি ও বিতরণ করা হবে) ঘিরে যেসব ঘটনার খবর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, সেসব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে আগ্রহী পেশাদারদের গঠিত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম। বৈশ্বিক মহামারি করোনায় ইতিমধ্যে লাখ লাখ লোকের প্রাণ গেছে এবং কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। তদুপরি এর দ্বারা প্রতি মাসে বৈশ্বিক অর্থনীতির ৩৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়ে চলেছে।

টিকার পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধির (যেমন, মুখে মাস্ক ব্যবহার, ঘন ঘন হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা) কঠোর প্রয়োগ মহামারি নিয়ন্ত্রণ, জীবনের মর্মান্তিক ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস এবং অর্থনীতিকে ঠিক জায়গায় আনতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতির ওপর করোনার বিরূপ প্রভাব কমানোর একমাত্র উপায় বিশ্বব্যাপী সকল ব্যক্তির এই টিকা পাওয়ার ন্যায্য অধিকার (বিশেষত স্বাস্থ্যকর্মী ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের সুরক্ষা) নিশ্চিত করা।

কোভিড-১৯ পরীক্ষা, চিকিৎসা এবং টিকার উন্নয়ন, উৎপাদন ও ন্যায়সংগত অধিকার ত্বরান্বিত করার জন্য একাধিক উন্নয়ন অংশীদারদের দ্বারা অ্যাক্সেস টু কোভিড-১৯ (এসিটি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) দ্বারা সমন্বয় করা হয়েছে। কোভাক্স এসিটির অন্যতম স্তম্ভ এবং গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন (জিএভিআই), কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপারেডনেস ইনোভেশনস (সিইপিআই) এবং ডব্লিউএইচও-এর তদারকিতে রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

করোনায় তীব্রভাবে আক্রান্ত অন্যান্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেরও করোনার টিকার খুব প্রয়োজন। যেহেতু কোভ্যাক্স বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার সবার জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার ২০ শতাংশ সরবরাহ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেহেতু বাংলাদেশ সরকারকে তার ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষকে স্বল্প সময়ের মধ্যে টিকা দেওয়া নিশ্চিত করতে দ্বিপক্ষীয়ভাবে অন্যান্য বিকল্পগুলোর সন্ধান করতে হবে।

করোনাভাইরাসের টিকা বানানো তখন ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কোভাক্সের লক্ষ্য ছিল টিকার উদ্ভাবন ও উৎপাদন ত্বরান্বিত করা এবং বিশ্বের প্রতিটি দেশের জন্য ন্যায্যমূল্য এবং ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত করা। কোভ্যাক্সের গবেষণা উন্নয়ন উৎপাদন বিনিয়োগ কমিটি একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি গ্রুপ। এই গ্রুপে রয়েছেন শিল্প বিশেষজ্ঞরা, যাঁরা কোভ্যাক্সের অর্থায়নে পরিচালিত সম্ভাব্য টিকা প্রকল্পগুলোতে টিকা উন্নয়ন এবং উৎপাদন ত্বরান্বিত করতে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করেন।

ইনোভিও, মডার্না, কিউরভ্যাক, নোভাভ্যাক্স, হংকং বিশ্ববিদ্যালয়, থেমিস/ইনস্টিটিউট পাস্তুর/পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় (মার্ক), ক্লোভার বায়োফার্মাটিক্যালস এবং অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকাসহ বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য টিকা প্রকল্প কোভাক্সের আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা পেয়েছে, যা তাদের রেকর্ড দ্রুত সময়ের মধ্যে করোনাভাইরাসের টিকাগুলোর দ্রুত বিকাশে সক্ষম করে তুলে।

অক্সফোর্ড (অ্যাস্ট্রাজেনেকা) তাদের করোনা টিকা বিকাশের জন্য কোভ্যাক্স থেকে ‘জনস্বার্থে’ ৩৮৪ দশমিক ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পেয়েছিল। এই সাহায্য দুই ভাগে মঞ্জুর করা হয়: ২০২০ সালের মার্চে প্রাথমিক অনুদান, যা প্রি ক্লিনিক্যাল এবং প্রথম ধাপের পরীক্ষায় (১.১ মিলিয়ন ডলার) সাহায্য করতে এবং ২০২০ সালের জুনে টিকা উৎপাদনের জন্য প্রযুক্তি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্থানান্তরে সাহায্য করতে (৩৮৩ মিলিয়ন ডলার)।

এই অনুদান কঠোর শর্তে দেওয়া হয়েছিল যে অক্সফোর্ড (অ্যাস্ট্রাজেনেকা) এবং এর উৎপাদনকারী অংশীদারদের অবশ্যই মহামারি চলাকালে অলাভজনক ভিত্তিতে টিকাগুলো বিক্রি করতে রাজি থাকতে হবে এবং সে অনুসারে অক্সফোর্ড (অ্যাস্ট্রাজেনেকা) প্রকাশ্যে বিবৃতি দেয় যে এই টিকাটি মহামারিকালে অলাভজনক ভিত্তিতেই বিক্রি করা হবে।

অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকা আর্জেন্টিনা, চীন, ভারত, জাপান, মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া এবং রাশিয়ার বেশ কয়েকটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তি স্থানান্তর করেছিল। সেরাম ইনস্টিটিউট হলো সেই চুক্তির অধীন ভারতের একটি টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, যেখানে কোভ্যাক্সের সহায়তা পাওয়া অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রযুক্তি সরবরাহ করা হয়েছিল। কিন্তু ভারত সরকার এই চুক্তি উৎপাদন ব্যবস্থায় কোনো পক্ষ নয়

বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড (বেক্সিমকো ফার্মা), বাংলাদেশে নিবন্ধিত একটি বেসরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, যা বাংলাদেশে অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার একমাত্র পরিবেশক। তারা করোনাভাইরাসের টিকার ৩০ মিলিয়ন ডোজের একমাত্র উৎস সরবরাহকারী এবং পরিবেশনকারীরূপে সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) স্থান করে নেয়, যেখানে বাংলাদেশ সরকার ছিল বা সহ-স্বাক্ষরকারী।
এটি কোভ্যাক্স দ্বারা প্রকাশ্যে প্রকাশিত পূর্বের বক্তব্যের বিপরীত যে তাদের গবেষণা ও উন্নয়ন সুবিধা থেকে আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে যেকোনো টিকা তৈরি হলে তা ‘গ্লোবাল পাবলিক গুড’ হিসেবে গণ্য হবে এবং একেবারে বাণিজ্যিকীকরণ করা হবে না।

করোনায় তীব্রভাবে আক্রান্ত অন্যান্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেরও করোনার টিকার খুব প্রয়োজন। যেহেতু কোভ্যাক্স বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার সবার জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার ২০ শতাংশ সরবরাহ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেহেতু বাংলাদেশ সরকারকে তার ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষকে স্বল্প সময়ের মধ্যে টিকা দেওয়া নিশ্চিত করতে দ্বিপক্ষীয়ভাবে অন্যান্য বিকল্পগুলোর সন্ধান করতে হবে।

তবে বাংলাদেশে সেরাম ইনস্টিটিউটের একমাত্র পরিবেশক হিসেবে বেক্সিমকো ফার্মার আত্মপ্রকাশ এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে অংশ নেওয়া বেশ কয়েকটি প্রশ্নের জন্ম দেয়।

প্রথমত, এটি কি আগের ঘোষণার লঙ্ঘন নয়, যেখানে বলা হয়েছিল অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাসহ কোভ্যাক্সের গবেষণা উন্নয়ন উৎপাদন বিনিয়োগ কমিটির সহায়তায় বিকশিত ও উৎপাদিত সব টিকাগুলো গ্লোবাল পাবলিক গুড এবং সব দেশ অলাভজনক ভিত্তিতে সেগুলোর অধিকার লাভ করবে?

ভুলে ভরা জাতীয় পরিচয়পত্র

জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্ষেপে এনআইডি কার্ড হলো বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক নথি, যা বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হওয়া যেকোনো মানুষ পাওয়ার অধিকারী। ২০১৬ সালের আগের জাতীয় পরিচয়পত্রে শুধু ব্যক্তির নাম, পিতা ও মাতার নাম, জন্মতারিখ, আইডি নম্বর, ছবি ও স্বাক্ষর উল্লেখ ছিল। ২০১৬ সালে দেওয়া স্মার্ট কার্ডে একটি ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট কার্ড (আইসিসি) সংযুক্ত আছে, যা চিপ কার্ড নামেও পরিচিত। স্মার্ট কার্ডে এ চিপ কার্ড মেশিনের সাহায্যে রিড করা যায়। এই স্মার্ট কার্ডে নাগরিকের সব তথ্য সংরক্ষিত আছে।

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের এনআইডি বিভাগ নাগরিকদের পরিচয়পত্র সরবরাহ করে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য যদিও ছিল নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি। পরবর্তীকালে চাকরি, জমি রেজিস্ট্রেশন, পাসপোর্ট তৈরি, ব্যাংক হিসাব খোলা, মোবাইল সিম কার্ড কেনা, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংযোগ, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাসহ গুরুত্বপূর্ণ সব কাজেই এখন জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবহার বাধ্যতামূলক। স্বাভাবিকভাবে আশা করা গিয়েছিল, পরিচয়পত্রটি নির্ভুল ও ত্রুটিমুক্ত হবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় সেবার অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দায়সারা কাজ করেন, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

প্রথম আলোর আক্কেলপুর প্রতিনিধির পাঠানো খবরে একটি পরিবারের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা অনেক পরিবারের বা নাগরিকের ক্ষেত্রে ঘটেছে। জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বালাইট পূর্ব পাড়া গ্রামের বাসিন্দা মোছলিম উদ্দীনের প্রকৃত বয়স ৭৫ বছরের বেশি। জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর জন্মতারিখ লেখা আছে ২৮ অক্টোবর ১৯৫৯। তাঁর স্ত্রী মোছা. ছুরতন বেগমের জন্ম ২৪ এপ্রিল ১৯৬২, যা তাঁর প্রকৃত বয়সের চেয়ে অনেক কম। সবচেয়ে হাস্যকর যে তাঁদের বড় সন্তান সোবহানের বয়স দেখানো হয়েছে ১ জুন ১৯৬৩। বাবার চেয়ে চার বছর ও মায়ের চেয়ে ১০ মাস কম। এই বৃদ্ধ বয়সে মোছলিম উদ্দীন ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করলেও সরকারের কাছে বয়স্ক ভাতার জন্য আবেদন করতে পারছেন না জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স কম লেখার কারণে। বগুড়ার ধুনট উপজেলায় একজন মহিলার স্বামীর নামের স্থলে বাবার নাম দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কেবল কালাই বা ধুনট উপজেলা নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় খোঁজ নিলে লাখ লাখ ভুলে ভরা জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া যাবে। পরিচয়পত্রের ভুলের কারণে নাগরিকেরা পদে পদে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। অনেকে রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, বয়স সংশোধনের জন্য আবেদন করতে হলে বিয়ের কাবিননামাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হবে। কিন্তু মোছলিম উদ্দীন ও ছুরতন বেগমের মতো বয়সী মানুষের অনেকের কাবিননামাই নেই। তাঁরা কেন প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন?

নির্বাচন কমিশনের পক্ষে বর্তমান লোকবল দিয়ে নির্ভুল পরিচয়পত্র দেওয়া সম্ভব কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কিছুদিন আগে দায়িত্বটি অন্য কোনো সংস্থার কাছে ন্যস্ত করার কথাও উঠেছিল। ভুলে ভরা জাতীয় পরিচয়পত্রগুলো অবিলম্বে সংশোধন করা প্রয়োজন। জাতীয়ভাবে নাগরিকদের একটি নির্ভুল ডেটাবেইস বা উপাত্ত ভিত্তি তৈরি হলে কাজটি সহজ হতো।